বিয়ের রাতে - শিক্ষামূলক গল্প


বাসর ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে অস্বস্তিতে ভুগছি। পরিবার থেকেই বিয়েটা হয়েছে আমার। বিয়েটা হঠাৎ করেই যেন হয়ে গেল। নিজেকে গুছানোরও একটু সময় পাইনি। পড়াশুনা শেষ করে চাকুরীতে জয়েন করেছি মাত্র একবছর। ভেবেছিলাম আরো কিছুটা সময় নিয়ে বিয়েটা করব।
কিন্তু হঠাৎ একদিন আম্মু ফোন করল লম্বা ছুটি নিয়ে বাড়িয়ে আসতে। কি যেন দরকার। বাড়িতে গিয়েই আসল ঘটনা বুঝতে পারলাম। দাদা খুব অসুস্থ। তার ইচ্ছা তিনি নাতবৌ এর মুখ দেখে যাবেন। তাই আমাকে এই জরুরী তলব।

যতই ভাবি বিয়ে করব না তবুও বিয়ের কথা শুনে মনের মধ্যে বসন্তের হাওয়া বইতে শুরু করল। খুব ইচ্ছে করছে আমার সারাজীবনের সঙ্গিনীটাকে একনজর দেখতে। ছোটবোনটাতে আড়ালে ডেকে নিয়ে হবু স্ত্রী মানে নিশির একটা ছবি ম্যানেজ করে দিতে বললাম। ছবি তো দিলই না বরং উল্টো ব্ল্যাকমেল শুরু করল। আমি হবু বৌ এর ছবি চেয়েছি এটা সবাইকে বলে দেবার ভয় দেখিয়ে অনেকগুলো টাকা হাতিয়ে নিল।
যাই হোক, ছবি দেখতে না পারলেও ওর সম্পর্কে মোটামুটি সবই জানতে পেরেছিলাম। আর এই মহান তথ্যদাত্রী ছিলেন আমার মা।নিশি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে, পরিবারের বড় মেয়ে। ওর সাথে নাকি আমার অনেক মিল। আম্মু বলেছে আমার যেসব বিষয় পছন্দ মেয়েটারও নাকি তাই পছন্দ। মনে মনে ভাবলাম তলে তলে তাহলে অনেকদূর এগিয়ে গেছ তোমরা। আর আমাকে কেউ একটা ছবি পর্যন্ত দিচ্ছে না

কপালটাই খারাপ মনে হচ্ছে। মানুষ বিয়ে করার আগে কতগুলো পাত্রী দেখে তারপর একটা পছন্দ করে বিয়ে করে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে একজন পাত্রী দেখারও সৌভাগ্য হলনা। বাবা মা দেখে এসে আমাকে না জানিয়েই বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। একবার চোখের দেখাটাও দেখতে পেলাম না। অন্তত একবার জিজ্ঞেস তো করতে পারত। যাই হোক সেটা নিয়ে দুঃখ নেই। এখন যদি কেউ ওর একটা ছবি দিত তাহলেই হত। কেউ সেই দয়াটাও কেউ করছে না। শেষ পর্যন্ত আমার দয়াময়ী মা আমার কষ্টটা বুঝলেন। দয়া করে একটা ছবি হাতে দিলেন। ছবিতে তো অপরুপ লাগছে। কিন্তু আজকাল ছবিকে বিশ্বাস নেই। সব ফটোশপের কারবার। ছবিতে পোড়া কয়লাকেও জুহি চাওলা মনে হয়
বিয়েটা হয়ে গেল। ঠিক এ মুহুর্তে বাসর ঘরটার সামনে একটা চেয়ারে বসেই স্মৃতিচারণ করছি। সারাদিন এত চেষ্টা করেও ওর মুখটা একবার দেখতে পারিনি। এত লম্বা করে কেউ ঘোমটা দেয় নাকি। তাছাড়া এত লোকের সামনে হাবলার মত তাঁকিয়ে তো থাকা যায় না। কিন্তু ওর মুখটা দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে আছে। মেজাজটা খারাপ হচ্ছে ছোট ভাইবোন গুলোর প্রতি। রাত ১২ টা বাজে অথচ এখনো নিশির কাছে বসে আছে। ওরা থাকলে তো আমি ঢুকতে পারছি না। মন চাইছে ভেতরে ঢুকে সবগুলোকে কান ধরে বের করে দেই। আর ভাবীগুলোও যে কই গিয়ে মরল আল্লাহ জানেন। উনারা তো একটু হেল্প করতে পারেন। বন্ধুদের কাছে শুনেছি ভাবীরা নাকি কত পরামর্শ দেয়,সাহায্য করে। কিন্তু আমার বেলায় কচু

যাক অবশেষে, রাত ১ টায় আমার ভেতরে যাবার অনুমতি মিলল। অনুমতি মিলল বললে ভুল হবে, এক ভাবীকে ম্যানেজ করে অনুমতি নিতে হল। অনুমতি পেতেই আমার ভেতরের আমিটা হুররে বলে একটা লাফ দিল। নাহ্, আরো দেরী করলে কেবল দেরীই করে যেতে হবে। মনে একটু সাহস নিয়ে ধুম করে দরজাটা ধাক্কা দিলাম। কিন্তু দরজাটা খুলল না। ভেতর থেকে লাগিয়ে দিয়েছে। কি করব বুঝতে পারছি না, ডাকাটাও তো কেমন দেখায়। মনের মধ্যে একটা ভয় উঁকি দিল। নিশি কি বিয়েটাতে রাজি ছিলনা?? কিন্তু এভাবে দরজা বন্ধ করে বসে না থেকে আমাকে তো সরাসরি বলতে পারে। প্রায় আধঘন্টা ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। দরজা খোলার কোন নাম নেই। শেষে আর থাকতে না পেরে আস্তে করে কড়া নাড়লাম দরজায়। প্রায় দুমিনিট শব্দ করার পর আস্তে আস্তে খুলে গেল দরজাটা

আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নিশি। এখন আর মাথায় ঘোমটা নেই। বিয়ের শাড়িটা পাল্টে অন্য একটা শাড়ি পড়ে আছে।এই প্রথমবারের মত সরাসরি ওকে দেখছি আমি। মাঝারী উচ্চতা, আয়ত নাকি টানা এসব বুঝিনা তবে অসাধারণ দুটি চোখ, লম্বা চুল, আর বাম চোখের নিচে ছোট্ট একটা তিল। ছবির থেকেও আনো অনেক বেশি সুন্দর লাগছে ওকে। কেমন যেন সম্মোহিত হয়ে গেছি ওকে দেখে। জোর করে সম্মোহনটা কাটিয়ে ওর দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে রইলাম। ও বুঝল আমার দৃ্ষ্টির মানে। তড়িঘড়ি করে বলল-

-সরি আসলে শাড়িটা পাল্টাচ্ছিলাম তো তাই...
- ও আচ্ছা
- একটা কথা বলার ছিল আপনাকে
মনের মধ্যে আবার সেই ভয়টা জেগে উঠেছে। না জানি ও কি বলবে। দরজা বন্ধ করাটাতে কি শাড়ি পাল্টানো ছাড়া আরো কিছু ছিল?? কিন্তু আমিতো প্রথম দেখাতেই ওর প্রেমে পড়ে গেছি। মনের ভয়টাকে প্রকাশ করলাম না। স্বাভাবিক গলায় কথা বলতে থাকলাম....
-হুম, বলুন
- আকাশে সুন্দর চাঁদ উঠেছে। আমার ইচ্ছে ছিল প্রথম রাতে বরকে নিয়ে চাঁদ দেখব। আপনি চাঁদ দেখবেন আমার সাথে???
মুহূর্তেই সব ভয় কর্পূরের মত উড়ে গেল। আমার মনের ইচ্ছাটাই যেন ওর মুখ থেকে উচ্চারিত হল। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারলাম-

- হ্যা অবশ্যই দেখব

আমারো ইচ্ছে ছিল ফুলশয্যার রাতে অর্ধাঙ্গীনির হাত ধরে জোৎস্না দেখব। ওরও একই ইচ্ছা শুনে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। আস্তে করে রুম বের হয়ে আকাশের চাঁদটার দিকে তাঁকিয়ে পাশে নিশির উপস্থিতি কামনা করছি। কিন্তু পেছন থেকে দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনতে পেলাম। নিশি আমাকে বাইরে রেখেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। বোকার মত বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। এতক্ষণে বুঝলাম ওর আসলে চাঁদ দেখার কোন ইচ্ছে ছিলনা। ওটা ছিল আমাকে বাইরে বের করার অজুহাত। এই অবস্থায় কেউ যদি আমাকে দেখে তাহলে মানসম্মানের দফারফা হয়ে যাবে। আস্তে করে কয়েকবার নিশিকে ডাকলাম। কিন্তু কোন সাড়া নেই। আরো কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর মনে হল এখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা নিরাপদ নয় তাই আমার বাসা থেকে ৫ মিনিটের হাঁটা পথ এক বন্ধুর বাসার দিকে রওয়ানা হলাম।রাতটা তো কাটাতে হবে
বন্ধুটা আমাকে দেখে খুব অবাক হল। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। হয়তো যা বুঝার বুঝে গেছে। যাই হোক, কোনমতে রাতটা কাটিয়ে ভোরে কেউ কিছু বুঝার আগেই বাড়িতে চলে এলাম। কেউ জানতেই পারল না রাতে কি ঘটেছে। সকালে নাস্তা করার সময় ছোটবোনটা বলল নিশি নাকি আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি জানি ও কি বলতে চায়। প্রথমরাতে স্বামীকে বের করে দেবার মানে তো একটাই ওর এ বিয়েতে মত নেই বা অন্য কোন রিলেশন আছে। ভুলটা আমারই বিয়ের আগে অন্তত একবার হলেও ওর সাথে কথা বলার দরকার ছিল। যাই হোক, আমি এখন দেখা করছি না ওর সাথে, ও যে কথাটা বলবে সেটা আমি সহ্য করতে পারব না। মুভিতে এরকম অনেক কাহিনী দেখেছি।

পুরোটা দিন কেটে গেল। এর মধ্যে নিশি বহুবার চেষ্টা করেছে আমার সাথে কথা বলতে কিন্তু আমি বারবার এড়িয়ে গেছি। আমি চাইনা এত তাড়াতাড়ি আমার স্বপ্নটা ভেঙে যাক।রাতের খাওয়ার সময়ও নিশি বারবার দেখছিল কিন্তু আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম। খাওয়া শেষেই নিজের রুমে না গিয়ে বন্ধুর বাসায় হাজির। আজকে বন্ধুটা চেপে ধরল ঘটনা কি জানার জন্য। তাই বাধ্য হয়ে সব খুলে বললাম।

- বিয়ের প্রথমদিন থেকেই বউকে ছেড়ে আছিস। কষ্ট হচ্ছে না?
-সেটা তো হচ্ছেই কিন্তু কি বা করার আছে!
-করার অনেক কিছুই আছে। সারাজীবন তো ভাল হয়েই রইলি কিন্তু কি পেলি। এবার একটু খারাপ হ
- মানে??
-মানে কিছুনা। রাতটা আমার এখানে না থেকে চল অন্য কোথাও কাটিয়ে আসি
- মানে কি??
- মানে কিছুনা, বউ যখন সময় দিচ্ছে না তখন অন্য মেয়ের কাছে যেতে সমস্যা কি!!

আমি বুঝতে পারছিলাম না বন্ধুটাকে কি বলব। খুব ঘনিষ্ট না হলে কষে একটা চড় দিতাম।হঠাৎ বন্ধুটার দিকে তাঁকিয়ে দেখি ওর মুখটা কেমন যেন শুকনো, আমার পেছনদিকে চোখ বড় বড় করে তাঁকিয়ে আছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও পেছনের দিকে তাঁকালাম। পেছনের দৃশ্যটা দেখে আমারো চোখ মার্বেলের মত হয়ে গেল। দেখলাম দরজাটার ঠিক কাছে নিশি চোখ লাল করে দাঁড়িয়ে আছে। এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন যুদ্ধংদেহী কোন দেবী। এগিয়ে এসে আমার শার্টের কলারটা ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলল আমাকে। রুমে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কলারটা ছাড়ল না। রুমে পৌছেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখ গরম করে তাঁকাল আমার দিকে

- আমি ছাড়া আর কোন মেয়ের দিকে তাঁকালে চোখে গেলে দেব
কথাটা শুনে আমার ভয়ের বদলে কেমন যেন ভাল লাগছিল। এবার ও রাগে নয় বরং আহত কন্ঠে বলতে শুরু করল-

আমি কি আপনার সাথে একটু মজাও করতে পারব না! ভেবেছিলাম আপনাকে কিছুক্ষণ বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে তারপর আমিও বের হব। কিন্তু আমি বের হয়ে আপনাকে আর পাইনি। সারাটারাত আপনার জন্য অপেক্ষা করেছি কিন্তু আপনি এলেন না। দিনের বেলায়ও আমাকে এড়িয়ে চলেছেন, ছোটবোনকে দিয়ে খবর পাঠালাম তবু আপনি এলেন না। তারপর সেই সন্ধ্যা থেকে আপনার অপেক্ষায় বসে আছি।আপনি আসেননি। আমি কি খুব অপরাধ করে ফেলেছি?

এ পর্যন্ত বলে ডুকরে কেঁদে উঠল নিশি। আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না।এতটা বোকা কেন আমি। একটু এগিয়ে কান্নারত নিশির মাথায় একটা হাত রাখলাম। ও আমার বুকে ওর আশ্রয় খুঁজে নিল। মুহুর্তে মনে হল পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন ধরা দিয়েছে দুটি বাহুতে... (সমাপ্ত)
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url